admin
- ১ মার্চ, ২০২৩ / ১১৬ Time View
Reading Time: 2 minutes
মুরাদ হোসেন, হাবিপ্রবি দিনাজপুর
পলান সরকার। যে নামটি শুনলেই বইয়ের কথা মনে পড়ে যায়। নামটি কেবল ব্যাক্তির নয়, নামটি বইপ্রেমিদের আত্ম অনুভূতির। রাজশাহী জেলার ২০ টি গ্রামজুড়ে গড়ে তুলেছিলেন শিক্ষা আন্দোলন। পুরো নাম হারেজ উদ্দিন সরকার। বাংলাদেশের একজন সমাজকর্মী, ২০১১ সালে সমাজসেবায় অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার একুশে পদকে ভুষিত করেন। নিজের টাকায় বই কিনে পড়তে দিয়েছেন পিছিয়ে পড়া গ্রামের মানুষগুলোকে। প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে কাঁধে ঝোলাভর্তি বই নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন। মাইলের পর মাইল হেঁটে একেকদিন একেক গ্রামে যেতেন। বাড়ি বাড়ি কড়া নেড়ে আগের সপ্তাহের বই ফেরত নিয়ে নতুন বই পড়তে দিতেন। এলাকাবাসীর কাছে “বইওয়ালা দাদুভাই” হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সাদা মনের মানুষ, আলোর ফেরিওয়ালা হিসেবে সর্বমহলে পরিচিত ছিলেন। পলান সরকারের নানা ময়েন উদ্দিন সরকার জমিদার ছিলেন। বৃটিশ আমলেই পলান সরকার যাত্রাদলে যোগ দিয়েছিলেন। ভাঁড়ের চরিত্রে অভিনয় করতেন। যাত্রার পাণ্ডুলিপি হাতে লিখে কপি করতেন। অন্যদিকে মঞ্চের পেছন থেকে অভিনেতা অভিনেত্রীদের সংলাপ বলে দিতেন। এভাবেই বই পড়ার নেশা জাগ্রত হয়। দীর্ঘদিন ধরে বাউসা হারুন অর রসিদ শাহ দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।
১৯৬৫ সালে বাউসা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় ৫২ শতাংশ জমি দান করার পর পলান সরকার স্থানীয়দের অনুরোধেই চেয়ারম্যান পদে আসীন হন। ১৯৯০ সাল থেকে বাউসা হারুন অর রসিদ শাহ দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রতিবছর যারা মেধাতালিকায় প্রথম দশটি স্থান অর্জন করত তাদের বই উপহার দিতেন পলান সরকার। এরপর অন্যান্য শিক্ষার্থীরাও তার কাছে বইয়ের আবদার করলে সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি তাদেরও বই দিবেন, তবে তা ফেরত দিতে হবে। এরপর গ্রামের মানুষও তার কাছে বই চাইতে শুরু করে। এভাবেই শুরু হয় বই পড়া আন্দোলনের ভিত।
১৯৯২ সালে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ায় পলান সরকারকে হাঁটার অভ্যাস করতে হয়। তখনই তার মাথায় এক অভিনব চিন্তা আসে। স্কুলকেন্দ্রিক বই বিতরণের প্রথা ভেঙে বাড়ি বাড়ি বই পৌঁছে দেয়া এবং ফেরত নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কোন বিয়ের অনুষ্ঠানে অন্যান্য জিনিসের পাশাপাশি তিনি বইও উপহার দিতেন। এছাড়া যারা তার চাল কলে দেনা পরিশোধ করে তাদেরও বই উপহার দিতেন।
২০০৯ সালে রাজশাহী জেলা পরিষদ পলান সরকারের বাড়ির আঙিনায় একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করে। প্রথমে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার কয়েকটি গ্রামের মানুষই জানত পলান সরকারের এই অসামান্য শিক্ষা আন্দোলনের গল্প। ২০০৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বিটিভিতে জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে পলান সরকারকে আলোকিত মানুষ হিসেবে তুলে ধরা হয়। ২০০৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের প্রথম সারির দৈনিক প্রথম আলোর ‘ছুটির দিনে’ সাময়িকীতে তাকে নিয়ে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ছাপা হয়, যার নাম ছিলো ‘বিনি পয়সায় বই বিলাই’। এরপর থেকে পলান সরকার সারাদেশে পরিচিতি পান। ২০১১ সালে সামাজসেবায় অবদানের জন্য রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদক লাভ করেন তিনি। ২০১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ‘ইমপ্যাক্ট জার্নালিজম ডে’ উপলক্ষে সারা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার দৈনিকে তাঁর উপর প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তার জীবনের ছায়া অবলম্বনে বিটিভির জন্য গোলাম সারোয়ার দোদুল নির্মাণ করেন ঈদের নাটক ‘অবদান’। বিনামূল্যে বই বিতরণ করে সকলের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ সৃষ্টির করার জন্য ইউনিলিভার বাংলাদেশ পলান সরকারকে ” সাদা মনের মানুষ” খেতাব পান। বই পড়ার আন্দোলনের যে রুপান্তর ঘটিয়েছেন পলান সরকার তা বর্তমান তরুণদের জন্য আদর্শ হতে পারেন। বই পড়া, বইকে আবাদ করার মধ্য দিয়েই পলান সরকার চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন বাঙালির মনে প্রাণে।